ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী—এক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক শহর। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ শহরটি আজ বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানকার বায়ুদূষণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে, যা শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। গত শনিবারও শহরটির বাতাস ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় ছিল। এদিন বিশ্বের ১২৪টি শহরের মধ্যে সকাল ১০টার দিকে বায়ুদূষণে রাজধানী ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্যানুযায়ী, ১৭৪ স্কোর নিয়ে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা।
এ দূষণের পেছনে অনেক কারণ জড়িত। ঢাকা শহরের রাস্তায় অসংখ্য যানবাহন চলাচল করে, যাদের বেশিরভাগই পুরোনো ও নিম্নমানের। জ্বালানি ব্যবহারে এ যানবাহনগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুকে দূষিত করে। একটা বাসের ‘ইকোনমিক লাইফ’ সাধারণত ১০-১৫ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। উন্নত দেশগুলোতে বাসের ইকোনমিক লাইফ শেষ হওয়ার পর সেগুলোকে সড়ক থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। কারণ কোনো যানবাহনের ইকোনমিক লাইফ শেষ হয়ে গেলে সেগুলো ঠিকভাবে জ্বালানি পোড়াতে পারে না এবং তখন সেগুলোর ধোঁয়ার সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যানবাহনের ইকোনমিক লাইফ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অবাধে চলাচল করতে পারে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং ট্রাফিক পুলিশদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে। দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের ‘দেশব্যাপী ৬৪ জেলার বায়ুদূষণ সমীক্ষা-২০২১’ অনুযায়ী, ঢাকার আশপাশের প্রায় ১ হাজার ২০০টি ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্পকারখানা আছে, যেগুলো দূষণের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ইটভাটা এখনো সনাতন পদ্ধতিতে চলছে। এসব ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা, কাঠ ব্যবহার করা হয়। ফলে এটা থেকে প্রচুর ছাই তৈরি হয় এবং কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের মতো দূষিত কণা বাতাসের সঙ্গে মেশে। শহরের আশপাশে অবস্থিত শিল্পকারখানাগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া ও রাসায়নিক পদার্থ বায়ুকে দূষিত করে। রাজধানীতে সারা বছরই ছোট-বড় অজস্র ভবন নির্মাণ ও রাস্তা মেরামতের কাজ চলে। এর পাশাপাশি গত কয়েক বছরে যোগ হয়েছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্প। যে কোনো ধরনের নির্মাণকাজ করার সময় বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে সেসব নিয়ম পালনের তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না। চলমান নির্মাণকাজ থেকে প্রচুর ধুলোবালি বাতাসে মেশে, যা বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শহরের বিভিন্ন স্থানে বর্জ্য জমে থাকে, যা পচে গিয়ে বায়ুকে দূষিত করে। বর্জ্য পোড়ানো বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। বায়ুদূষণের প্রভাব জনজীবনের ওপর অত্যন্ত ভয়াবহ। বায়ুদূষণের ফলে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক রোগ দেখা দিচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, যা জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বায়ুদূষণের কারণে মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বায়ুদূষণ রোধে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। পুরোনো ও নিম্নমানের যানবাহন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। শিল্পকারখানাগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া ও রাসায়নিক পদার্থ নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। শিল্পকারখানার বর্জ্য পদার্থ নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে, যাতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারে। নির্মাণকাজ থেকে নির্গত ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানোর মতো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ইটভাটাগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে এবং ইটভাটার ধোঁয়া যতটুকু সম্ভব ওপরের দিকে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে যাতে ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলে। প্রয়োজনে এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে। বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে, যাতে বায়ুদূষণ রোধ করা যায়।
ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ একটি জটিল সমস্যা, যার সমাধান সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সম্ভব। সরকারের পক্ষে কখনোই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না যদি না জনগণ সচেতন হয়। পাশাপাশি বায়ুদূষণ রোধে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। চলুন, আজ থেকেই আমরা শপথ নিই—বায়ুদূষণ রোধ করি, একে অন্যের জীবন রক্ষা করি।
শহিদুজ্জামান শাকিল, শিক্ষার্থী
ঢাকা কলেজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
মন্তব্য করুন