বাংলাদেশ সরকারের জনগণের প্রতি নির্দেশনা ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকার সাধারণ মানুষের জন্য নয় দফা নির্দেশনা জারি করে। শুরুতেই আহতদের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক বা কবিরাজের শরণাপন্ন হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। পরবর্তী নির্দেশনাগুলো মূলত মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত—সেখানে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্থানীয় শত্রুদের মোকাবিলা করতে বলা হয়, আওয়ামী লীগের নেতাদের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী করণীয় নির্ধারণের কথা বলা হয় এবং তরুণদের নিকটবর্তী মুক্তিফৌজ দপ্তরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
এছাড়া প্রতিটি গ্রামের প্রধানকে পার্শ্ববর্তী গ্রামপ্রধানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়, যাতে দ্রুত খবর বিনিময় সম্ভব হয়। মুক্তাঞ্চলে অবস্থানরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আওয়ামী লীগের স্থানীয় সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার কথাও বলা হয়। সন্দেহভাজনদের খোঁজ পেলে তা দ্রুত স্থানীয় মুক্তিফৌজ কেন্দ্রকে জানাতে বলা হয়। নদী পরিবহনকর্মীরা পাকিস্তানি বাহিনীর আদেশ অমান্য করায় বাংলাদেশ সরকার তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লক্ষ্ণৌ সফরে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, চীনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে সমর্থন দিলেও ভারত নীরব দর্শকের ভূমিকা নেবে না। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে ভারত নির্লিপ্ত থাকতে পারে না বলে তিনি জোর দিয়ে বলেন।
ভারতের রাজস্থান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য ১০ লাখ রুপি অনুদান ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ফ্রেড হ্যারিস সিনেটে দেওয়া বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের ওপর চালানো হত্যাকাণ্ডে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এই হত্যাযজ্ঞের সংবাদ মিথ্যা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য বন্ধ করা উচিত।
সাবেক যুগোস্লাভিয়ার রাজনৈতিক সংগঠন 'ইউগোস্লাভ লিগ ফর পিস, ইনডিপেনডেন্স অ্যান্ড ইকুয়ালিটি অব পিপলস' এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানায়।
পাকিস্তানপন্থিদের অবস্থান ঢাকায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে শান্তি কমিটির উদ্যোগে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়, যেখানে খান এ সবুর, খাজা খয়েরউদ্দিন ও কবি বেনজীর আহমদের মতো ব্যক্তিরা অংশ নেন। সেইসঙ্গে বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক ও রাজনৈতিক সংগঠন—যেমন প্রাদেশিক মুসলিম লীগ, নগর মুসলিম লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগ, জাতীয় যুব পরিষদ, জমিয়াতুল ইত্তেহাদ এবং ইসলামী সংগ্রাম পরিষদ—পাকিস্তানের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা জানিয়ে আলাদা বিবৃতি দেয়।
যুদ্ধের বিস্তার ও গতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে জড়িয়ে পড়েন:
রংপুর অঞ্চল: তিস্তা রেলসেতুতে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক আক্রমণ চালায়, যার ফলে তারা পিছু হটে শিঙের ডাবরি, রাজার হাট ও টগরাইহাটে অবস্থান নেয়। বদরগঞ্জেও ট্যাংক হামলার মুখে পড়ে তারা।
ঠাকুরগাঁও: স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআর সদস্যরা ঠাকুরগাঁও সীমান্তে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন। পাকিস্তানি বাহিনী সম্মুখ সমর এড়িয়ে খানসামার দিকে ঘুরে গিয়ে আক্রমণ করতে চাইলে নদী পারাপারের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রাজশাহী: সেনানিবাস এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর পদাতিক, আর্টিলারি ও বিমান হামলার মুখে পড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সরে গিয়ে নতুনভাবে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলেন।
পুঠিয়া: বানেশ্বরে এক তীব্র সংঘর্ষে একাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনী বানেশ্বর ও সারদা দখল করে। এরপর সারদা নদীতীরে শতাধিক সাধারণ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে ঘটে সারদা গণহত্যা, যা ইতিহাসে এক হৃদয়বিদারক অধ্যায় হয়ে আছে।
গোয়ালন্দ ঘাট: সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি জলযান ডুবিয়ে দেন, যা তাদের পিছু হটতে বাধ্য করে।
টাঙ্গাইল: মধুপুর গড় অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের হঠাৎ আক্রমণে দুই পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: আখাউড়ার গঙ্গাসাগর সেতুতে অবস্থানরত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের মাঝেও তাদের অবস্থান বজায় রাখেন।
যশোর ও নড়াইল: পাকিস্তানি বাহিনী যশোর থেকে নড়াইল পৌঁছালে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধারা আগেই শহর ত্যাগ করেছেন।
চট্টগ্রাম: কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে প্রার্থনার সময় হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।
সিলেট: লাক্কাতুরায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বহু চা-শ্রমিককে হত্যা করে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও সাত; দৈনিক পাকিস্তান, ১৪ এপ্রিল ১৯৭১।
মন্তব্য করুন